সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক


উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫) একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। তিনি কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১] কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।

রচনা

প্রবন্ধ

ছোট গল্প

  • তাস (১৯৫৪)
  • শীত বিকেল (১৯৫৯)
  • রক্তগোলাপ (১৯৬৪)
  • আরন্দের মৃত্যু (১৯৬৭)
  • প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২)
  • সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০)
  • জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০)
  • শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)

কবিতা

  • একদা এক রাজ্যে (১৯৬১)
  • বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯)
  • বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০)
  • প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩)
  • অপর পুরুষ (১৯৭৮)
  • পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০)
  • নিজস্ব বিষয় (১৯৮২)
  • রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮)
  • বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯)
  • এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯)
  • অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯)
  • কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০)
  • আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০)
  • তোরাপের ভাই (১৯৯০)
  • শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০)
  • রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১)
  • নাভিমূলে ভস্মাধার
  • কবিতা সংগ্রহ
  • প্রেমের কবিতা
  • ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯)

উপন্যাস

  • এক মহিলার ছবি (১৯৫৯)
  • অনুপম দিন (১৯৬২)
  • সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)
  • নীল দংশন (১৯৮১)
  • স্মৃতিমেধ (১৯৮৬)
  • মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬)
  • স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭)
  • এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭)
  • স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯)
  • বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খন্ড ১৯৮৯, ২য় খন্ড ১৯৯০)
  • বারো দিনের শিশু (১৯৮৯)
  • বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯)
  • ত্রাহি (১৯৮৯)
  • তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯)
  • কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯)
  • শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০)
  • নির্বাসিতা (১৯৯০)
  • নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০)
  • খেলা রাম খেলে যা (১৯৯১)
  • মেঘ ও মেশিন (১৯৯১)
  • ইহা মানুষ (১৯৯১)
  • মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার
  • দ্বিতীয় দিনের কাহিনী
  • বালিকার চন্দ্রযান
  • আয়না বিবির পালা
  • কালঘর্ম
  • দূরত্ব
  • না যেয়ো না
  • অন্য এক আলিঙ্গন
  • এক মুঠো জন্মভূমি
  • বুকঝিম ভালোবাসা
  • অচেনা
  • আলোর জন্য
  • রাজার সুন্দরী

কাব্যনাট্য

  • পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬)
  • গণনায়ক (১৯৭৬)
  • নুরুলদীনের সারা জীবন (১৯৮২)
  • এখানে এখন (১৯৮৮)
  • কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১)
  • ঈর্ষা

কথা কাব্য

  • অন্তর্গত

গল্প

  • তাস
  • রক্ত গোলাপ

অনুবাদ

  • ম্যাকবেথ
  • টেম্পেস্ট
  • শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯)

শিশুসাহিত্য

  • সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮)
  • আনু বড় হয়
  • হড়সনের বন্দুক

অন্যান্য

  • শ্রেষ্ঠ গল্প
  • শ্রেষ্ঠ উপন্যাস
  • শ্রেষ্ঠ কবিতা
  • মুখ (১৯৯১)
  • পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় [৩]

চলচিত্র

নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে গেরিলা ছবিটি তৈরি হয়েছে
পরানের গহীর ভিতর ১১ সৈয়দ শামসুল হক

কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।

একেই বুঝি মানুষ বলে সৈয়দ শামসুল হক

নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।

স্বাধীনতা দিবসঃ ২০০৭ সৈয়দ শামসুল হক
Posted on জুন 30, 2010 by rashal05
ধরা পড়ছে, ধরা পড়ছে আয়নাতে চেহারা।
ধরা পড়ছে এক্সরে প্লেটে স্বপ্নখাদক কারা।
ধরা পড়ছে, ধরা পড়ছে- হাতকড়াতে হাত।
চলছে মাকু, চলছে জোরে ইতিহাসের তাঁত।
অনেক ছিলো নষ্টামি আর অনেকগুলো দিন-
তার ভেতরে ঘুরছে কালের কলের গানে পিন!
গানের অনেক রকম আছে- একাত্টরের গান!
স্বাধীনতার দিবস আসে, কে দেবে শ্লোগান?
মুখ খোলা তো বারণ, তাই কথা কোয়ো না কেউ।
শ্লোগান দেবে গাছের পাতা, নদীর জলে ঢেউ।
মানুষ আবার পলিমাটির দখল নেবে ফিরে।
মশাল জ্বেলে জাগছে ওরা আঁধার রাত্তিরে।
আর কতটা দীর্ঘ হবে অমাবশ্যার রাত!
শক্ত হাতে চালাও জোরে ইতিহাসের তাঁত।
লাল সূর্যের ছবি ফোটাও বয়ন করা বস্ত্রে-
স্বাধীনতার মন্ত্রে এবং একাত্তরের অস্ত্রে।
ভালোবাসার দিনে সৈয়দ শামসুল হক

রাতের অন্ধকার এখন আমার ছবি আকার ক্যানভাস ।
তোমার চোখের আলো আমার রঙ ।
একদিন তোমাকে যে ছঁয়েছি সেই আঙুল আমার তুলি এখন ।
আমি তো্মার ঘুমের ছবি আঁকছি ।
তুমি নিলীন হয়ে শুয়ে আছো এখন আমার ছবির ভেতরে।
এই ঘুম থেকে তোমাকে আমি জাগবো না ।
অস্থির পৃথিবী থেকে তুলে এনে ভালবাসার দুহাতে
তোমাকে এখন আমার স্থিরতার পটে স্থাপন করে ছলেছি ।
পৃথিবী্র সব রূপসীরা আমার পাশে দারিয়ে দেখছে তোমাকে,
আমি তাদের ঈর্ষা দিচ্ছি কেননা তারা স্থিরতা পায় নি ।
আমি একটু পরেই শুয়ে পড়বো তোমার পাশে -
তারপর একটু করে প্রান্তর ভরে উঠবে ঘাষে ।
কালের গ্রহণ লাগা চাঁদ তখন বেরিয়ে এসে
আমাদের দুজনেরই ছবি আঁকবে- যে দেখবে সে দেখবে ।

নোট বই থেকে সৈয়দ শামসুল হক

একদিন দুপুর-রোদ্দুরে তুমি নিয়ে এলে একখণ্ড নীল-
তোমার সূতির শাড়ি, সমুদ্রের সাথে যার অনিবার্য মিল;
আয়োজনে সে যেমন ঘিরে আছে পৃথিবীকে, শাড়িও তোমাকে
জীবনের বিপুল রহস্যগুলো সমুদ্রই চুরি করে রাখে।

আরো একজন সৈয়দ শামসুল হক

যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।
যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন।
যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন।
যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন।
যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন।
তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?
সে তো আমাদেরই সৈয়দ শামসুল হক

হঠাৎ এ কোন গ্রামে এসে গেলে তুমি!
কোথাও সড়ক নেই, শুধু জলাভূমি
যেন কেউ কেঁদে কেঁদে ঝরিয়েছে জলÑ
জলে তার চোখের কাজল।
অথবা সে আকাশের নীলে
ছায়া ফেলে জলসঙ্গী ঝিলে।
চলা থামেÑ এখানেই থামা পথিকের
যে হোক সে হোক সে তো আমাদেরইÑ
সে তো আমাদের।

এখন মধ্যরাত সৈয়দ শামসুল হক

এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।
পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।

তুমিই শুধু তুমি সৈয়দ শামসুল হক

তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমিসকল শব্দভুমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি
নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।
এমন তুমি রেখেছ ঘিরেএমন করে সব
যেদিকে যাইতুমিই শুধুতুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!
একুশের কবিতা সৈয়দ শামসুল হক

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।।

আমার পরিচয় সৈয়দ শামসুল হক

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালাথেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

পরানের গহীর ভিতর ১ সৈয়দ শামসুল হক

জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷
আমি একটুখানি দাঁড়াব সৈয়দ শামসুল হক

আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;
শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;
না, আমি থেকে যেতে আসিনি;
এ আমার গন্তব্য নয়;
আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই
এখান থেকে
চলে যাব।
আমি চলে যাব
তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি
এর মার্চপাস্টের যে সমীকরণ
এবং এর হেলিকপ্টারের যে চংক্রমণ,
তার তল দিয়ে তড়িঘড়ি;
আমি চলে যাব
তোমাদের কমার্সিয়াল ব্লকগুলোর জানালা থেকে
অনবরত যে বমন
সেই টিকার-টেপের নিচ দিয়ে
এক্ষুনি;
আমি চলে যাব
তোমাদের কম্পিউটারগুলোর ভেতরে যে
বায়ো-ডাটার সংরক্ষণ
তার পলকহীন চোখ এড়িয়ে
অবিলম্বে;
আমি চলে যাব
যেমন আমি যাচ্ছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে
ধীরে ধীরে
বহুকাল ধরে
আমি একটি
দুটি
তিনটি
প্রজন্ম ধরে।
আমি কথা দিচ্ছি
তোমাদের কোনো রমণীকে আমি চুম্বন করব না;
আমি কথা দিচ্ছি
তোমাদের কোনো সন্তানকে আমি কোলে করব না;
এবং কথা দিচ্ছি
তোমাদের এপার্টমেন্টের জন্যে আমি দরখাস্ত করব না,
তোমাদের ব্যাংক থেকে আমি ঋণ গ্রহণ করব না,
তোমাদের শাসন-পরিষদে আমি সদস্য হতে চাইব না,
তোমাদের নির্বাচনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না;
এবং আমি আরো কথা দিচ্ছি
তোমাদের বেতারে কোন ভাষণ দেব না,
তোমাদের কম্পিউটারে কোন তথ্য ফিড করব না,
তোমাদের হেলিকপ্টারে আমি উড্ডীন হতে চাইব না,
তোমাদের মার্চপাস্টে আমি ড্রামবাদক হব না।
তোমাদের এপার্টমেন্ট আমার কষ্ট,
তোমাদের উনোন আমার কষ্ট,
তোমাদের ব্যাংক আমার কষ্ট,
তোমাদের পরিষদ আমার কষ্ট,
তোমাদের আয়না আমার কষ্ট,
তোমাদের গেলাশ আমার কষ্ট,
তোমাদের রমণী আমার কষ্ট,
তোমাদের সন্তান আমার কষ্ট।
আমি শুধু একটু সময় দাঁড়িয়ে দেখে যাব-
এ সবের ভেতর দিয়েই তো আমার বাড়ি যাবার পথ,
আমি বাড়ি যাব,
পৃথিবীতে সমস্ত বাড়ি যাবার পথেই আছে
এরকম একেকটি শহর;
আমি এক্ষুনি এগিয়ে যাব।
তোমাদের যে এপার্টমেন্ট, আমি জানি, তার ছাদ নেই;
তোমাদের যে উনোন, আমি জানি, তার আগুন নেই;
তোমাদের যে ব্যাংক, আমি জানি, তার স্বচ্ছলতা নেই;
তোমাদের যে পরিষদ কারো সম্মতি নেই;
তোমাদের যে আয়না কোনো প্রতিফলন নেই;
তোমাদের যে গেলাশ কোনো পানীয় নেই;
আমি জানি
তোমাদের রমণীদের গর্ভধারণ করবার ক্ষমতা নেই;
আমার জানা আছে
তোমাদের সন্তানদের হাতে শস্যের একটিও বীজ নেই।
একটি দুটি তিনটি প্রজন্ম ধরে আমি
একাধিক যুদ্ধ একটি শান্তিকে,
একাধিক মন্বন্তর একটি ফসলকে,
একাধিক স্তব্ধতা একটি উচ্চারণকে,
একাধিক গণহত্যা একটি নৌকোকে,
একাধিক পতাকা একটি স্বাধীনতাকে
শরীরে আমার বীভৎস ক্ষতের মধ্যে লাল স্পন্দনের মতো
অনুভব করতে করতে
এই যে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি-
সে একটি বাড়ির দিকে যে কখনো ভেঙে পড়ে না,
সে একটি উনোনের দিকে যে কখনো নিভে যায় না,
সে একটি ব্যাংকের দিকে যে কখনো দেউলে হয় না,
সে একটি পরিষদের দিকে যে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করে না,
এমন একটি আয়নার দিকে যেখানে প্রতিফলন,
এমন একটি গেলাশের দিকে যেখানে পরিস্রুত পানীয়,
এমন একটি রমণীর দিকে যে এইমাত্র চুল খুলেছে,
এমন এক সন্তানের দিকে যে এইমাত্র বর্ষায় ভিজেছে।
আমার এই অগ্রসর
সে তোমাদের ভেতর দিয়েই অগ্রসর।
রাতের পর রাত ভেঙে উৎকর্ণ জন্তুর মতো চলেছি
চাঁদের নিচে পানির সন্ধানে,
সমস্ত স্তব্ধতাকে মাকড়শার জালের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে
গুহাবন্দী মানুষের মতো আমি চলেছি
পানির শব্দ নির্ণয় করে।
আমি এখনো জানি না তার শেষে অপেক্ষা করছে কিনা
একটি রমণী অথবা তার হাঁসুলী ছেঁড়া পুঁতি;
আমি এখনো জানি না তার শেষে দেখতে পাব কিনা
সরোবরের ভেতরে চাঁদ অথবা কাদার ভেতরে করোটি।
তবু আমাকে যেতে হবে
এবং তবু আমাকে যেতেই হবে, সহস্র ক্ষত শরীরে।
তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে যেতে
যদিবা আমার চোখে পড়ল কচিৎ একটি যুগল
যাদের গান এখনো বহন করতে বাতাস বড় ইচ্ছুক,
আমি জানি আমিও তো একটি যুগল হতে চেয়েছি-
তাই আমার একটুখানি থামা।
যদিবা আমার চোখে পড়ল ছেঁড়া কিছু কাগজ
যার ভেতরে বন্দী কোনো কবির লেখা ছিন্ন কটি অক্ষর,
আমি জানি আমিও তো একটি কবিতার জন্যে কলম ধরেছি-
তাই আমার একটু এই দাঁড়ানো।
যদিবা আমার চোখে পড়ল শাদা একটি ফুল
যা রাতের অন্ধকারে ছোট্ট কিন্তু তীব্র সুগন্ধ নিয়ে ফুটেছিল,
আমি জানি আমিও তো একটি উদ্যানই আমার স্বপ্নে দেখেছি-
তাই আমার একটু শুধু বিরতি।
আমাকে এক রমণী তার রাতের প্রস্তুতি নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হবে;
আমাকে একটি কাগজ তার কবিতার সম্ভাবনা নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হবে;
আমাকে একটি উদ্যান তার চারাগাছগুলো নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হচ্ছে
আমাকে ডাকছে একটি শিশু,
আমাকে ডাকছে একটি রাষ্ট্র,
আমাকে ডাকছে একটি আয়না তার সমুখে স্থাপিত হবার জন্যে।
তাই একটুখানি দাঁড়িয়েই আমি এগিয়ে যাব আবার
যেমন যাচ্ছিলাম
ধীরে ধীরে
বহুকাল ধরে
আমি একটি
দুটি
তিনটি
প্রজন্ম ধরে।
তোমাদের ভেতর দিয়েই তো সর্বকাল চলে গেছে আমার পথ
এবং সর্বকাল আমি দাঁড়িয়েছি আমি আবার নিয়েছি পথ।

বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে সৈয়দ শামসুল হক

এই পৃথিবীতে আর আকাশ দেখিনি আমি এতো_ অবনত_
ঘুমন্ত শিশুর মুখে যেন চুমো খাবে পিতা নামিয়েছে_ মুখ;
প্রান্তর এতোটা বড় যেন মাতৃশরীরের ঘ্রাণলাগা শাড়ি;
আদিকবি পয়ারের মতো অন্তমিল নদী এতো শান্তস্বর;
এতোই সজল মাটি কৃষকের পিঠ যেন ঘামে ভিজে আছে;
যদিও বৃষ্টির কাল নয় তবু গাছ এতো ধোয়ানো সবুজ;
দেখিনি এমন করে পাখিদের কাছে ব্যর্থ ব্যাধের ধনুক_
মানুষের কাঁধটিকে বৃক্ষ জেনে বসে তারা এতো স্বাভাবিক;
এ কেমন?_ এমনও কি ভিটে হয় কারো এই পৃথিবীতে যার
বাড়ির গভীরে আছে সকলের বাড়িঘর এতোখানি নিয়ে;
এভাবে ওলান থেকে অবিরল দুধ ঝরে পড়ে যায়_ এতো
শব্দ কোন গ্রামে আমি কোন বিবরণের আর কখনো পাইনি;
কোথাও দেখিনি আর একটি পল্লীতে এতো অপেক্ষায় আছে
রাখালের মতো তার গ্রীবা তুলে মানুষের স্বপ্নের সময়।
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
সকল পথের পথ পল্লীটির দিকে অবিরাম ঘুরে গেছে_
গিয়েছিল_ একদা যখন এই পল্লীটির কালো মাটি থেকে
একটি নতুন শিশু উঠে এসেছিল, আর এই পল্লীটিরই
পাশ দিয়ে মাটির দুধের মতো বহে যাওয়া নদীটিতে নেয়ে
ক্রমে বড় হয়েছিল আর চেতনার কামারশালায় বসে
মানুষের হাতুড়ি নেহাই লোহা প্রযুক্তির পাঠ নিয়েছিল,
সকল পল্লীকে তার আপনার পল্লী করেছিল। সেই তাঁরই
টগবগে দীর্ঘদেহ ছিল, মানুষ দেখেছে_ দেখেছিল তাঁকে_
বাংলার বদ্বীপব্যাপী কংকালের মিছিলের পুরোভাগে, তাঁকে
দেখেছিল চৈত্রের অগি্নতে তারা, আষাঢ়ের বর্ষণের কালে,
মাঘের শীতার্ত রাতে এবং ফাল্গুন ফুল যখন ঝরেছে,
যখন শুকিয়ে গেছে পদ্মা, আর যখন সে বিশাল হয়েছে;
যখন ষাঁড়ের ক্ষুর দেবে গেছে আর মাটি রক্তে ভিজে গেছে,
যখন সময়, আর ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি শুরু হয়ে গেছে
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
টেনে নেবে পথ; যদিও অনেকে আজ পথটিকে ভুলে গেছে,
যদিও এইতো দেখি, কন্টিকারী ফেলে ফেলে পথটিকে কেউ
পথিকের জন্যে বড় দুর্গম করেছে এবং যদিও জানি
কেউ কেউ আমাদের পথের সম্বল সব খাদ্যপাত্রগুলো
মলভাণ্ডরূপে আজ ব্যবহার করে; বিষ্ঠায় পতিত হবে
অচিরে তারাই; আমি করতল থেকে খুঁটে খাবো; সঙ্গ দেবে
আমাদেরই পথের কবিতা; আমাদের প্রধান কবিকে যারা
একদিন হত্যা করে তাঁর জন্মপল্লীটিতে মাটিচাপা দেয়_
কতটুকু জানে তারা, কত ব্যর্থ? জেগে ছিল তাঁর দুটি হাত,
মাটি গভীর থেকে আজো সেই হাত_ পুরানোকথার মতো_
স্মৃতির ভেতর থেকে উচ্চারণমালা, নদীর গভীর থেকে
নৌকোর গলুই, পথিকের পদতল কাঁটায় রক্তাক্ত যদি,
সেই রক্ত শোধ হোক তাঁর কাছে ঋণ; মানব প্রসিদ্ধ কৃষি
খুব ধীরে কাজ করছে; পাখিরা নির্ভয়; আর আমিও পৌছেছি;
আমারই ভেতর-শস্য-টেনে নিয়ে এলো আজ আমারই বাড়িতে।
















































































































নিঃসঙ্গ কবিনির্জন রেস্তোরাঁ – সৈয়দ শামসুল হক

মাথার ভেতরে লেখা। অদূরে রেস্তোরাঁ।
আষাঢ় সেজেছে খুব মেঘে মেঘে-মনে সে করাবে
বিরহ বিপন্ন দিন-রাস্তাঘাট আদ্যোপান্ত খোঁড়া।
মাটির পাহাড়গুলো কতদিনে কে জানে সরাবে!
এরই মধ্যে পথ করে নিতে হবে আজ।
অপেক্ষায় কবিতা ও কফি।
হঠাৎ বৃষ্টির শুরু, ধমকাল বাজ।
পিছলে পা পড়ে গেল কবি।
সমস্ত শরীরে কাদা। এভাবে কি যাওয়া যেতে পারে?
বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে কেটে যায় কাল।
তবুও কি প্রেম কিছু ছাড়ে?
বিরহেও রয়েছে বহাল!
যদিও পিছল পথ, জামা কাদা লেপা।
হেঁটে চলো, হেঁটে চলো, দাঁড়িয়ে থেকো না।
সময় যতই হোক বিরুদ্ধ বা খেপা-
কবিতাকে ঠেকিয়ে রেখো না।
কবিতা কি থেমে থাকবার!
দুর্গতির একশেষ, খাতা তবু শক্ত হাতে ধরা।
হাতছানি দেয় কফি, আলো রেস্তোরাঁর,
দুধের বদলে ্নৃতি, কালো কফি, শব্দের শর্করা ু

বৃষ্টিভেজা গন্ধ ছড়ায় ফুলদানিতে ফুল।
ঘটিয়ে দেয় ইন্দ্রজাল রাতের রেস্তোরাঁয়।
একলা বুকে আছড়ে পড়ে ও কার খোলা চুল।
আষাঢ় এলে পদ্মা পাগল-পেলেই ভূমি খায়!
আগুন ওঠে দপদপিয়ে, লাফাতে চায় খাড়া-
ভোলা তো খুব সহজ নয় চিরে ফেলার ধাঁচ।
অতীতও নয় গেছেন কবি নক্ষত্রের পাড়া,
সেদিন কবি জেনেছিলেন স্বর্গীয় তার আঁচ।
ফুলের সাথে চুলের গন্ধ এখন একাকার।
এখন শুধু গন্ধটুকুই-এবং অন্ধকার ু

কফির গরম গন্ধ। পেয়ালায় আঁকা দুটি ফুল
দীর্ঘ দুটি বৃন্তে তারা পরস্পর জড়িয়ে রয়েছে।
কত দীর্ঘদিন কবি রেস্তোরাঁয় এসেছে ও
একাকী সহেছে
বিরহ বিচ্ছেদ তার। আষাঢ়ের বৃষ্টিপাত হয়েছে তুমুল।
কবিতার খাতাটি পাশেই।
রেস্তোরাঁয় একা কবি চুমুকে চুমুকে
পান করে চলে কফি।
পৃথিবী বিপুল আর লেখার বিষয় তার
হতে পারে সবই।
কিন্তু আজ সেই মুখ-একটি সে মুখ ছাড়া
আর কিছু নেই।
ভোরের প্রথম আলো প্রতি ভোরে পড়ে সেই মুখে।
ফুরোয় না ভালোবাসা-কফি শেষ হয়ে যায়
চুমুকে চুমুকে

সে নেই, তবুও কবি আসে রেস্তোরাঁয়।
ধীরে কালো কফি ঢালে শাদা পেয়ালায়।
এই সে চেয়ার আর এই সে টেবিল।
জানালার পর্দা ওড়ে এখনো তো নীল।
শূন্যতার রং শাদা, মৃত্যু ঘন কালো।
যা ছিল জীবনব্যাপী-মুহূর্তে মিলাল।
এখনো টেবিলে ফুল-ছাইদান পড়ে।
কেবল সে নেই আর। স্মৃতি হয়ে ওড়ে
ছাইদানে ছাই আজ করুণ বাতাসে।
রেস্তোরাঁয় সেদিনের ফুলগন্ধ ভাসে।
স্মৃতির নদীতে নেভা আলোর বিকন।
কালির কলমে লেখা জলের লিখন
মৃত্যুর শরীর ভেঙে সৈয়দ শামসুল হক

বিদ্যুতেরও সাধ্য নেই রুদ্ধ করে রক্তের প্রবাহ
যেভাবে রাতের ঘরে এলে তুমি দাঁড়ালে যখন
শরীরের বস্ত্র ছেড়ে, চুলে ঝড়, যখন উধাও
লজ্জার সকল শীল, মরে যাই আমি যে তখন!
বিপুল সমুদ্র দেখে ছোট এক জাহাজের মাঝি
ধ্রুবতারা লক্ষ্যহারা, কম্পাসের কাঁটাও বিকল
তখন যে হয় তার হাহাকার, কীভাবে যে বাঁচি
চারদিকে নাচে তার রাক্ষুসীর জল ছলচ্ছল।
সেই মতো তোমার সমুখে আমি একান্ত বাসরে
নতজানু ক্রমে হই সাক্ষাত মৃত্যুর দেখা পেয়ে
সমুদ্র তখন নয় ভেসে থাকি রতির চাদরে,
হর্ষের বদ্বীপমুখে প্রাণপণে চলি দাঁড় বেয়ে
তোমার সম্মত দেহেসারারাতসারারাত আমি
মৃত্যুর শরীর ভেঙে রতিপথ ধরে স্বর্গগামী ।

সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকার

আমাদের এ সময়ে যার নামের সঙ্গে সব্যসাচী বিশেষণটি যায়, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। বিচিত্র মাধ্যমে তিনি তার সৃষ্টিশীলতা প্রবাহিত করলেও কবিসত্তার যে উদ্বোধন তিনি বোধহয় তা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কবিসত্তা, কবিতা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন কালের খেয়ার বিভাগীয় সম্পাদক ফারুক আহমেদ। সেই কথোপকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে পত্রস্থ হলো : ফারুক আহমেদ : আপনি জন্মেছেন কুড়িগ্রামে। আপনার নানা লেখায় যে জলেশ্বরীর কথা আসে, তা কি কুড়িগ্রামে, নাকি কল্পনার ভূমিতে গড়ে ওঠা কোনো নদী। সৈয়দ শামসুল হক : তোমার সঙ্গে কথা বলার আগে একটি কথা বলি_ অধিকাংশ সময় দেখি আমার সঙ্গে যারা কথা বলতে আসেন, তাদের বেশিরভাগই আমার সম্পর্কে পড়াশোনা না করেই আসে। তোমাকে আমি তার মধ্যে ফেলছি না। কিন্তু একটি বিষয় আমার কাছে খুব অবাক লাগে। আমার মনে হয় কেউ যদি একজন কবি, লেখক বা শিল্পীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাহলে অবশ্যই সে লেখক বা শিল্পীর সৃষ্টি সম্পর্ক একটা স্পষ্ট ধারণা নিয়ে আসা প্রয়োজন। তুমি যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করলে, তাতে মনে হলো খোঁজখবর করে তারপর এসেছ। আমি একটি শহরের নাম দিয়েছি জলেশ্বরী এবং একটি অঞ্চলের নামও বটে। এ কোনো মহকুমা শহর নয়, এটি একটি ছোট্ট শহর। এরকম অনেক অঞ্চলকে আমি কল্পনায় গড়ে তুলেছি। যেমন_ বুড়িরচর, নবগ্রাম, শুকুনমারী, বলধারচর, মান্দারবাড়ি, হরিসার, হস্তিবাড়ি। এগুলো সব আমার কল্পনার। এর সঙ্গে একটি নদীও আছে_ আধকোষা নদী, আধকোষা মানে অর্ধকোষ। এই যে অঞ্চলটি আমি গড়ে তুলেছি। এটি আমার কল্পনায় যদিও; তবে কল্পনায় তো লেখা যায় না, বাস্তবে এর শেকড় থাকতেই হয়_ কী মানুষ, কী পটভূমি, কী নদী, কী গ্রাম। এসব আমি কুড়িগ্রামের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছি। কেন আমি সে জায়গাটি নিয়েছি তাও বলি। কারণ, যারা বিশাল বাংলায় থাকেন (আমি মফস্বল শব্দটি পছন্দ করি না), তাদের নিয়ে যখন গল্প, কবিতা, নাটক লিখতে যাই, তো প্রতিবারই একটি নতুন শহর বা গ্রামের কথা ভাবাটা পণ্ডশ্রম। সেজন্য আমি একটি কল্পনার ভূগোল জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। এটির শুরু ১৯৭৪ সালে, যখন আমি দ্বিতীয় দিনের কাহিনীনামে উপন্যাসটি লিখি। আরেকটি কথা এখানে বলা দরকার, বিশেষ করে জলেশ্বরীর পটভূমিতে যেসব গল্প-উপন্যাস লিখেছি, তার কোনো কোনো চরিত্র এ-গল্প থেকে ও-গল্পে এসেছে। এ গল্পে যখন অপ্রধান চরিত্রটি আরেক গল্পে প্রধান চরিত্র হয়েছে; কিংবা কোনো উপন্যাসে আগের চার-পাঁচটি গল্পের তিন-চারটি চরিত্র এখানে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ আমি একটি পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে চেয়েছি। সমালোচনার ভাষায় যাকে এপিক বলে শনাক্ত করা হচ্ছে। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত এসব চরিত্র, গল্প-উপন্যাস নিয়ে একটি এপিক গড়ে তোলা যাবে। কখনও না কখনও, কেউ না কেউ যারা আমার গল্প বা উপন্যাসের ব্যাপারে আগ্রহী তারা এসব গল্প-উপন্যাসের ভেতর চরিত্রগুলোর যাতায়াত আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন বলে আমার বিশ্বাস। ফা. আ. : সাহিত্যের বিচিত্র মাধ্যমে আপনার পদচারণা। কোনো কোনো সময় উপন্যাস লিখছেন, কোনো কোনো সময় কবিতা, কাব্যনাট্য। যখন যা লিখছেন, তখন কি তাই লিখেন, না একই সময়ে নানান মাধ্যমে লিখেন। সৈ. শা. হক : এমন নয় যে আমি যখন উপন্যাস লিখছি, তখন আর কিছুই লিখছি না বা যখন কবিতা লিখছি তখন গল্পের কথা ভাবছি না বা নাটকের। একসঙ্গে একাধিক লেখা আমার পক্ষে কোনো নতুন কিছু নয়। তবে আমি নিরন্তরভাবে আমার ভেতরে কবিতার তাড়না অনুভব করি। এটি আজকে নয়, ধরো ১৪/১৫ বছর থেকে অনুভব করে চলেছি। কবিতা অন্তঃশীলভাবে আমার ভেতর বয়ে চলেছে। এর মাঝখানে হয়তো অন্য জলধারা মেশে_ তেমনি গল্প-উপন্যাস-নাটক ইত্যাদি আমার ভেতরে কাজ করতে থাকে। ফা. আ. : শুনেছি মাইকেলও এক সঙ্গে একাধিক লেখার ডিকটেশন দিতেনসৈ. শা. হক : তুমি যে বললে মাইকেল এক সঙ্গে একাধিক লেখা লিখতেন, এটি গল্প-গুজব, এটি বনফুলের লেখা নাটক শ্রী মধুসূধনথেকে এসেছে এবং বনফুল নাটকীয় কারণে ওইভাবে ঘটনাটা সাজিয়েছেন। বাস্তবে আমার তা মনে হয় না। তবে এটা ঠিক, এক সঙ্গে বিচিত্র লেখা, লেখা সম্ভব। মাইকেল নিশ্চয়ই করেছেন। মাইকেলের প্রধান সমস্ত লেখা পাঁচ বছরের মধ্যে এবং ওই রকম একটি ঘনীভূত সময়ের মধ্যে একটার ওপর আরেকটা লেখা ছায়া ফেলেছে কাজের দিক থেকে, ভাবের দিক থেকে এবং সময়ের দিক থেকে, আমি তা মনে করি। আমার ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে যে, একটা গল্প লিখতে আমার সাধারণত একদিনের বেশি সময় লাগে না। কোনো কোনো গল্পে দুদিন লেগেছে আর উপন্যাস কেন, নাটক কেন_ আমার লেখার বিশেষ দিকের কথা বলি, তা হলো_ আমি যে লেখাই লিখি না কেন, তা পুরোপুরি আমার ভেতর না আসা পর্যন্ত আমি কলম ধরি না। আমি লিখতে লিখতে ভাবি না বা ভাবতে ভাবতে লিখি না। ভাবনাটা আমার কাছে সম্পূর্ণভাবে ধরা না দেওয়া পর্যন্ত কলম কাগজে ছোঁয়াই না বা ল্যাপটপের চাবিতে আঙুল ছোঁয়াই না। ফলে আমার লিখতে খুব কম সময় লাগে; কিন্তু ভাবতে অনেক সময় লাগে। একটি উপন্যাস ১৯৫৩ সালে আমার মাথায় আসে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত মনে করি না আমার ভাবনাটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়েছে, পুরো আকার পেয়েছে যে লিখব। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। আর দেখ, এই যে আমি কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখছি, এসব কিন্তু ভাষা মাধ্যম, ভাষা মাধ্যমে। ভাবনাটা এমন নয় যে এটাকে একবার কবিতা করব, একবার গল্প করব, ভাবছি। মাধ্যমটাসহ ধরা পড়ে। আবার দেখা যায় কোন একটা ভাষা কবিতায় ধরা পড়ল। তখন এটার ছন্দ কী হবে তা সহজেই আমার কাছে ধরা পড়ে। ফলে আমি সহজাতভাবেই সে মাধ্যমে ভাষাটাকে রূপ দিই। ফা. আ. : বইয়ের নাম কবিতাই হোক বা উল্লেখযোগ্য কবিতার হিসেবে হোক যেমন_ ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালাবা পরাণের গহীন ভেতর’_ এগুলো দীর্ঘ কবিতা। বাংলা কবিতায় একই সঙ্গে দীর্ঘ এবং সফল কবিতা খুব বেশি নেই। এরকম দীর্ঘ কবিতা লেখার কৌশল আয়ত্ত করছেন কোত্থেকে বা কোন প্রেরণা থেকে। একেকটা দীর্ঘ কবিতা মানে বিরাট এক পটভূমিও তাতে রচিত হয়_ এ পটভূমি কি মাধ্যম হিসেবে গল্পে আসতে পারতো না? সৈ. শা. হক : দেখ, ‘পরাণের গহীন ভেতরকিন্তু দীর্ঘ কবিতা নয়। পরবে পরবে এসেছে, পরে দেখেছি তেত্রিশটা হয়ে গেছে। আমার দীর্ঘ কবিতার ভেতর প্রথম হচ্ছে বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, তারপরআমার শহরপাঁচটা তরঙ্গে, অতিসম্প্রতি হে অমর আগুন পাখি’_ যা নতুন পর্যায়ে লেখা বলা যায়। দীর্ঘ কবিতা যেমন_ ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালার প্রথম তিনটি চরণ বহুদিন ধরে আমি লিখছি কবিতা,/বহুদিন থেকে আমি লিখি না কবিতা;/লিখিনি কবিতা পূর্বে, পরে, বর্তমানে?’ সে সময়টায় কিন্তু সত্যিই বহুদিন পর্যন্ত কবিতা আমার কাছে ধরা দিচ্ছি না বা আমি ধরা পড়ছিলাম না কবিতার কাছে। সেটা ছিল শূন্য মরু সময়। সে মরু সময়টাই আমার দিকে আমাকে তাকাতে অনুপ্রাণিত করে। এই যে আমি লিখেছি, এখন লিখি না_ কবিতা নিয়ে আমি কী করতে চেয়েছি_ তারপর পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক_ সে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। শুধু রাজনীতি নয়, সে সময় আমাদের মনোজগতে অনেক কিছু ঘটেছে। মনকে এমনভাবে তরঙ্গায়িত করা নানা ঘটনা, অনুভূতি আমি ধীরে ধীরে একটা সময়ে কবিতার শরীরে ধরার চেষ্টা করি। এ কবিতা একটানা এগার দিনে লিখেছি। সে সময় আমার স্ত্রী ভোর ৭টার মধ্যে অপিসে চলে যেতেন আর আমি ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লিখতাম। তবে এটা যে দীর্ঘ হবে তা ভেবে লিখিনি। আমার কথাগুলো লিখতে লিখতে প্রায় ১৪শপঙ্ক্তি হয়ে যায়, এখন ৭-৮শপঙ্ক্তি। হওয়ার পর তোমরা বলছ দীর্ঘ কবিতা, আমিও দেখছি। কবিতা কবিতাই। দীর্ঘ, হ্রষ_ তা কোনো বিষয় নয়। তবে আমি কাজ করেছি আন্তরিকতার সঙ্গে। সব সময় একটা কথা বলার চেষ্টা করছি, তুমি রাজনীতিই কর, ছবি আঁকো, নাচ কর বা মানুষের জন্য রাস্তায় নাম, মিছিল-মিটিং কর, অস্ত্র ধর_ তোমার কাজের ভেতর একটা সততা এবং শেকড় সংগ্নতা চাই-ই চাই এবং তুমি ভুলে যেও না তোমাকে শেষ করে দিতে পারে বিরূপ সময়, কিন্তু তুমি সেই আগুন পাখি, সেই ফিনিক্স যে তার ভস্ম থেকে জেগে ওঠে, যে এক ফোটা রক্ত থেকে উড্ডীন হতে পারে, এ কথাটা বলতে চেয়েছি। ফা. আ. : এখানে আরেকটা প্রশ্ন_ কবিতায় পরাণের গহীন ভেতর’-এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় জাদুকর/যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভেতর। বা নুরুলদীনের সারাজীবন’-জাগো বাহে কোন্ঠে সবাইজনপ্রিয় উচ্চারণ। তবে মজার বিষয় দুটোই আঞ্চলিক ভাষায় লিখা। এ ভাষা কি আপনি কৈশোরের আত্মস্থ করেছিলেন? সৈ. শা. হক : দেখ, বাংলাতেই আমি তিন রকম ভাষায় কথা বলি। এই তোমার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলছি, তা তো আমার মায়ের সঙ্গে বলতাম না। আমি যখন কুড়িগ্রাম যাই, তখন সেখানে আমি কুড়িগ্রামের ভাষায় কথা বলি। ছোটবেলা, বড়বেলা নয় আমি এখনও সাবলীলভাবে সে ভাষায় যেতে পারি। নুরুলদীনের সারাজীবনরংপুরের ঘটনা। তবে তারপরও ওই ভাষাটাকে একটা মার্জিত রূপ দিতে চেষ্টা করেছি, যাতে সবার জন্য বোধগম্য হয়। আর যে ভাষাই কথা বলো না কেন, সব ভাষাই যখন তুমি ব্যবহার করছ, তা ঊর্ধ্ব কমার ভেতর কৃত্রিম, শিল্পীর রঙের মতো, সঙ্গীতজ্ঞের সপ্তসুরের মতো মতো_ এটা প্রতিদিনের ব্যবহার্য নয়। এভাবে দেখা দরকার। পরাণের গহীন ভেতর’-এর ভাষার সঙ্গে আমার মায়ের অঞ্চলের যোগাযোগ আছে। আমার মা মানিকগঞ্জের, বাবা সিরাজগঞ্জের, আমি জন্মেছি কুড়িগ্রামে। পরাণের গহীন ভেতরর ভাষা নিয়েছি পাবনা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা এ রকম বিস্তৃত অঞ্চল থেকে। তবে বাক্য গঠনের দিকে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে। বাক্য গঠনেরও একটা ভেদ আছে। আমি সেটাসহ ব্যবহারের চেষ্টা করেছি। ফা. আ. : এখন কবিতায় ছন্দের থেকে বা অন্তমিলের সঙ্গে সঙ্গে গদ্যে কবিতা লিখা হচ্ছে। চিত্রকল্পও প্রধান হতে দেখা যায়_ এ সময়ের কবিতাকে আপনি কীভাবে দেখেন? সৈ. শা. হক : আজকাল কে কীভাবে লিখছে তার পরিসংখ্যান পাওয়াটা তো মুশকিল। ছন্দেও লিখছে আবার ভাবছন্দেও অর্থাৎ গদ্যেও। কোনটায় বেশি লেখা হচ্ছে, কোনটায় কম তা নয়। তাছাড়া মিল এবং ছন্দ এ দুটি তো বাড়তি উপকরণ, সেটা ব্যবহার করতে অসুবিধা কোথায়। তবে যারা ভাবছন্দ অর্থাৎ গদ্যে লিখছে, তাদেরও ছন্দজ্ঞানটা বেশি পাকা হওয়া দরকার। আর চিত্রকল্পের একটা দিকের কথা বলি, এখন যা লেখা হচ্ছে তাতে দেখতে পাই হয়তো একটা সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করেছে। কিন্তু সেটার ধারাবাহিকতা, সেটাকে ঘিরে যে বুনট, তা আমি দেখতে পারছি না। হচ্ছে না বলা ঠিক না, দেখছি না। একটি স্মরণীয়, বিস্ময়কর, অসাধারণ চিত্রকল্প হয়তো ধরা যায়_ কিন্তু ওটাকে কেন্দ্র করে চারদিকে যে আবর্ত বা সংবর্ত তা না করতে পারলে ওই বিস্ময়, চমক তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ধর, জীবনানন্দ দাশেরবনলতা সেনকবিতায় একটা ইউনিটি আছে। ফা. আ. : আপনি লিখছেন এবং এই লেখার মধ্যে সেই আগের তীক্ষষ্টতা পুরো মাত্রায় রয়েছে, অতিসাম্প্রতিক একজন কবিও আপনাকে তার সমসাময়িক বলে মনে করে_ লিখছেন দীর্ঘ কবিতাও। এ কি প্রতিনিয়ত পাঠের ফলে সম্ভব হচ্ছে। সৈ. শা. হক : এটা বলা মুশকিল। তবে আমি সবসময় আমার ভেতরে একটা সৃজনের তাড়না বোধ করি। আমি আঠারো বা সতেরো বছর বয়সে যে তাড়না, প্রেরণা, যে দৃষ্টি থেকে লিখতাম তা এখন আরও ঘনীভূত হয়েছে। আমি জানি, অনেকেযে নদী মরু পথে হয়ে যায়…’এখন পর্যন্ত আমার সে রকম হয়নি। প্রতিদিন আমি নতুন নতুন কথা দেখতে পাই। সে কথাগুলো থেকে কিছু শিল্পে স্থাপন করি। এর মধ্যে কবিতা নিরন্তর চলতে থাকে। ফা. আ. : আপনার বিখ্যাত গল্পের মধ্যে আছেমানুষ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘তাসবা এ রকম অনেক গল্প। কবিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় গল্প লিখতে গেলে একটা জড়তা টের পাওয়া যায়। আপনি যখন গদ্যে লিখেন, তখন কি সহজাতভাবেই কবিতার বাইরের যে গদ্যের রূপ তাতে সরাসরি প্রবেশ করেন। সৈ. শা. হক : আমি এ সমস্যা অনুভব করি না। আমাদের ভেতর অনেকে আছেন, কেউ কেউ আমার বন্ধুজন, অনেকে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, তাদের কবিতা যতটুকু উচ্চমানের, গদ্য কিন্তু তার ধারে-কাছেও নেই। একটা কথা বলি, একজন কবির গদ্য দেখলে বোঝা যায়, তার কবিতা কতটুকু সক্ষম। আমি বিশ্বাস করি একজন বড় কবি যতটুকুই লিখেন, ততটুকুতেই তার গদ্যের চমকপ্রদতা টের পাওয়া যায়। তার গদ্য কখনও দুর্বল হতে পারে না। কোনোমতেই হতে পারে না। বরং কোনো বড় কবির গদ্য যদি দুর্বল দেখি তাহলে বুঝব তার কবিতা আমরা মাপতে ভুল করেছি। কারণ কবিতায় একটা নিজস্ব ভাষা গড়ে তোলা হয়। সেক্ষেত্রে কেন তার গদ্য দুর্বল হবে। ভাষা হচ্ছে আমাদের একটি বাহ্যিক উপকরণ, এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকেরই অনেক বেশি সতর্ক, মনোযোগী এবং আবিষ্কারক হওয়া প্রয়োজন। মূল দিকনির্দেশনা এর ভেতর থেকে আসে। ফা. আ. : যে আপনার প্রিয় দুএকজন কবির সম্পর্কে বলুন। যাদের কবিতা_ আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে বা প্রেরণা জুগিয়েছে? সৈয়দ শামসুল হক : প্রভাব ফেলার বিষয়টি আমি স্বীকার করি না। আমি নিজের কবিতা নিজে পড়ি না, তাহলে বলতাম, আমার কবিতাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। কারণ আমার কবিতা আমার কাছে প্রিয় না হলে ছাপতে দেব কেন? এখানে শামসুর রাহমানের কিছু কিছু কবিতা আমার ভালো লাগে। এবং আমার মনে হয় এ ভালো লাগাটা অনেকদিন আমার কাছে থাকবে। যদিও তার অনেক কবিতা আমার কাছে যথেষ্ট প্রিয় বলে মনে ধরে না। আর এখানকার ভেতর আল মাহমুদের কিছু কবিতা আমি খুব পছন্দ করি, শহীদ কাদরীর কবিতা পছন্দ করি, আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা, রফিক আজাদের কবিতা পছন্দ করি। এখানে অনেকেই আমার পরে এসেছে, কিন্তু তাতে তাদের কবিতা আমাকে স্পর্শ করছে না, তা নয়। কোনো না কোনোভাবে আমার মনের ওপর কাজ করছে। আরেকটি ভাষা, যা ছোটবেলা থেকেই আমি অভ্যস্ত, সেই ইংরেজি ভাষায় আমার অনেক প্রিয় কবি আছেন। শেলি, কিটস, অড্রে, ইয়েটস, এলিয়ট, পল এলিয়ন আমাকে স্পর্শ করে, বোদলেয়ার কিন্তু ততটুকু নয়। এ রকম অগণিত নাম আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব তা মুশকিল। ফা. আ. : আপনি তো ছবিও আঁকন। কিন্তু সে জগৎটা তেমনভাবে এখনও উন্মোচিত হয়নি। আপনার ছবি সম্পর্কে বলুন। সৈ. শা. হক : এটা আমার পক্ষে বলা উচিত হবে না। কারণ বছরখানেকের ভেতর আমি একটি প্রদর্শনী করব বলে ভাবছি। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার কবিতার সঙ্গে আঁকা ছবির খুব একটা ভিন্নতা অনুভব করবে না। আমি খুব বলিষ্ঠ দাগে ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি, কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। আমার পেলব কবিতা, নরম কবিতা, ঠাট্টাভাবে যাকে বলি রাঁধা কবিতা, তা আমার খুব একটা নেই। ফা. আ. : যারা এ সময় কবিতা লিখছে তাদের প্রতি কোনো পরামর্শ? সৈ. শা. হক : এখন প্রচুর মানুষ। প্রচুর মানুষ হলে কলরব-কোলাহল, এর মানে সৃষ্টিশীলতা নয়। গুটিকয় মানুষ হলে কলবর খুব একটা হয় না। কোলাহল হচ্ছে, এর সঙ্গে বেশি বেশি সৃষ্টিও হচ্ছে এতে মন্দের দিকটা আছে, তবে ভালো লেখাও হচ্ছে তা ঠিক। সবাই লিখতে শুরু করেছে। চলি্লশ বছর সময় ওদের দাও, তারপর দেখা যাবে। তবে লিখতে হবে। দশটা কবিতা বা পদ্য লিখলে একটা কবিতা হবে, দশটা কবিতা লিখলে একটা ভালো কবিতা হবে, দশটি ভালো কবিতা লিখতে পারলে একটি স্মরণীয় কবিতা হবে, দশটি স্মরণীয় কবিতা লিখতে পারলে একটি মহৎ কবিতা হবে। অর্থাৎ একটা চন্দন গাছের জন্য বিশাল অরণ্য তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ লিখবে হবে।

প্রেমের পদ্যের নেপথ্যে সৈয়দ শামসুল হক মহিলাকে, শিল্পীর উত্তর

লোকোত্তর কোনো এক গ্রন্থকীট, জ্ঞানী, দীর্ঘদিন
দর্শন, ভেষজ আর নীতিশাস্ত্র ভ্রমণের পর
ঢেকে দিয়ে আলো নিজ পরিচ্ছদে আনীত আঁধারে
সোনালি আপেল চেয়ে প্রার্থনায় করে উচ্চারণ।
একাকী অলিন্দে তার স্বগতোক্তি করে প্রদক্ষিণ,
মনোগত বাসনা বিলাস জ্বলে যেন রাত্রিভর
প্রমিত প্রদীপ এক পুরাতন স্বর্ণদীপাধারে,
অন্তিমে প্রস্তাব তার অলৌকিক নারীর চুম্বন।
আমি তার উত্তরাধিকারী, অপাঙ্গে যোজনা করো
বিদ্রূপের স্বর; জনান্তিকে বলো, ‘কেন সে শিল্পীকে
হতে হবে অনাচারী, বৃত্তকাম, অসুস্থ, অনয়?
কেন এ জরুরি যদি পরিণামে সর্বনাশ জ্ঞাত?‘
পরিণামে সর্বনাশ? হঠকারী যত মূর্খ মূঢ়
নিরূপণে সুতত্পর? কখনো কি ক্ষণিক সুপ্তিকে
অনন্ত প্রয়াণ বলো? আনন্দ তো সেই সূর্যোদয়
রশ্মি যার হর্ম্যদেহে চিত্রাবলী করে প্রতিভাত।
নিত্যকাল আমারও অন্বেষা সেই আনন্দ আকর,
অগম্য সম্ভোগে নয়, প্রেমিকার বিলোল মুদ্রায়।
সহজে উদ্ধৃত তাই আয়ু থেকে চব্বিশ বছর
এবং অনন্তকাল দুর্লভার চুম্বন তৃষায় ।

জানুয়ারি ১৯৫৮, ঢাকা



























































































































































































































































































































































মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্যারিসের চিঠি

প্যারিসের চিঠি শিরোনাম  : প্যারিসের চিঠি   লতিফুল ইসলাম শিবলী প্রিয় আকাশি, গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পয়েছি। খামের উপর নাম ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি তোমার হাতের লেখা; ঠিকানা পেলে কিভাবে লেখনি; কতদিন পর ঢাকার চিঠি; তাও তোমার লেখা, ভাবতে পারো আমার অবস্থা?? গতকাল প্যারিসে ঝরেছিলো এ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তুষারপাত। তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি; এই প্রথম আমি অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ। তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর বদলে যাওয়ার সংবাদ; তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছো - রাত্রির ঢাকা এখন নিয়নের স্নিগধতা ছেড়ে নিয়েছে উতকট সোডিয়ামের সজ্জা, আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন কালের সাক্ষী, শীতের বইমেলা পরিণত হয়েছে মিনাবাজারে, টি এস সি'র চত্বরে যেন উপ্তপ্ত বৈরুত। বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্বৃতি এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছো; এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও বদলে যেতে দেখলাম কত সুদুর ইতিহাস- বালির বাধের মতন ভেসে গেল বার্লিন প্রাচীর ... ইংলিস চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন; ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে, ক্ষিদে পেলেই ছিড়ে ছিড়ে খাও, স্বাধীনতা মানেই যেন উদর পুর্তি ...

ফুল ! তুমি ও এক নারী

শিরোনাম    ফুল !  তুমি  ও  এক  নারী                       শ্যামল সোম নারী ফুল হয়ে, ফুঁটছে  হৃদয়  কাননে, কাননের  নানা  গাছে, আহাহা ফুলের কী বাহার ! সেই সব গাছের ফুল ছিঁড়ে এনে, তোর  কামনার  আগুনে সেঁকে, জোছন ভরা আলো করা  রূপে মাতাল হওয়া  গন্ধে, আকুল হয়ে; হারামী  পুরুষ ! তুই প্রেমের মায়া জাল  ফেলে, রঙ্গিন  স্বপ্নের জাল বুনে, ফুলের সারা শরীরে আদরের বন্যায়, বন্য ভয়ঙ্কর তোর কঠিন পৌরুষের আঘাতে আঘাতে, ফুলের মতন নারীর পেলব শরীর থেকে খুবলে খেলি  একে  একে  চোখ  ঠোঁট,  স্তন, নাভীমূল, মাতৃ যোনী;  হায় ! পুরুষ যে দ্বারে তোর জন্ম, ঐ খানেই তোর মরন ! জোয়ান মরোদ গায়ে গতরে খেটে  মানব জমীন  চাষ  করে, সাজানো তোর  বাগানে  শত ফুল বিকশিত  কর, নইলে তুই দোজখের  আগুনে, নরকে  ফুট ন্ত তেলে পুড়বি, ভয়  হয় না তোর ? ওপরওয়ালার  ভয়াবহ  মারে -এডসে  রোগে বা  পক্ষাঘাতে-পঙ্গু  হয়ে বিছানায় শুয়ে ঈ শ্বরকে  হাজার ডাকলেও  তিনি  মুখ  ফিরিয়ে  থাকবেন, নারী যিনি,  সৃস্টির অধীশ্বরী !  ভগবতী যার  স্তন দুগ্ধে  শিশুর মরণ বাঁচন; তাঁকে ধ র্ষন  ভালোবাসা  ছলনায়,  জানি, খলের  ছলের  অভাব হয় না কখন, নারীর  সৌন্দর্য  নিয়ে 

নির্মল ভালবাসা

শিরোনাম : নির্মল ভালবাসা                      --- হেমন্ত রড্রিক্স  সমুদ্রের অতল গহ্বরে  শেওঁলা গুলো দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়,  বুঝে উঠা হয়নি কখন মনের গভীরে বেসামাল ভালবাসা তেমনই দানা বাঁধলো ?  কেরোসিন পিদিম মিটি মিটি আলো দেয় মৃদু মলয় পরশে সে যেন আহ্লাদিত। তোমার মুখাবয়ব আলো আধারে  সে এক ভিন্ন জগত সৃষ্টিতে নিমগ্ন ।  মেঘের গর্জে ওঠাকে ভয় পেওনা  দ্যুতিময় ঘর্ষণের পরক্ষণেই বর্ষিত ধারা । শীতল বায়ু বহে সমান্তরাল । ধুয়ে মুছে শুভ্র সুশীল ধরাতল।  দীনতা, অসৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী দৃশ্যতই  সত্যি প্রেমের গভীরতা অপরিমেয় । বিশ্বাস, সমঝোতা যার মজবুত খুঁটি ।  মরণোত্তর তাজমহল নয়, জীবদ্দশায় হাতে হাত রেখে চলার  অঙ্গীকারই "নির্মল ভালবাসা"।  (সেপ্টেম্বর তিরিশ  সিনসিনিটী  বিমান বন্দর ওহাইও, আমেরিকা  - সকাল নয়টা ।) ( কমেন্ট করতে ভুলবেন না কিন্তু ! নিচে দেখুন কমেন্ট বক্স)